Kaushik Roy | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭ : ৪১Kaushik Roy
জয়ন্ত ঘোষাল
বিগত একমাস ধরে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মুখরিত কলকাতা শহর। একটি সরকারি হাসপাতালে এক কর্মরত চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং তারপর হত্যার যে কাণ্ড নিয়ে শোরগোল, সেটি জঘন্যতম ঘটনা। এই ঘটনায় ধর্ষক এবং জড়িত থাকা এক বা একাধিক মানুষের কঠোরতম শাস্তি হোক— এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের ধারাবাহিক আন্দোলনের যেমন একটি মানবিক দিক আছে, ঠিক তেমন ভাবেই মনে হচ্ছে, এটাও জোর গলায় বলার সময় এসেছে যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যা নিজে ধর্না মঞ্চে এসে সামিল হয়েছেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে, যখন কালীঘাটে তাঁর বাসভবনে আলোচনার জন্য জুনিয়র ডাক্তারদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের প্রস্তাবিত বিষয় গুলি সম্পর্কে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন, যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তখন আলোচনায় আনুষ্ঠানিক ভাবে বসাটাই বোধহয় কাম্য।
পৃথিবীতে কোনও বিষয়েরই নিষ্পত্তি আসলে যুদ্ধ বা সংঘাতের মাধ্যমে হয় না। আন্দোলন থেকে যেটা শুরু হয়, বিপ্লবেও যা সুষ্ঠু পরিণতি পায়, সেটিও কিন্তু একটা সময়ের পর আলোচনার টেবিলে বসেই চূড়ান্ত হয়। সক্রেটিস যে কথোপকথনের মেথডোলজি তৈরি করে দিয়ে গেছিলেন, আজও সেটি প্রাসঙ্গিক। আলোচনার মাধ্যমে যেকোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে, যদি আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছানোর প্রকৃত সদিচ্ছা থাকে। আর যদি আন্দোলনে কনোটেশন এবং ডিনোটেশনের মধ্যে বিস্তর ফারাক থেকে যায়, যদি আন্দোলনটা আবশ্যিক শর্ত হলেও পর্যপ্ত শর্ত না হয়, যদি আন্দোলনটাকে টিকিয়ে রেখে শাসক সরকারকে দুর্বল করা, রাজ্যের সামগ্রিক ভাবে বিরোধী শিবিরকে অতিরিক্ত ভিটামিন জোগানো, তাহলে কিন্তু প্রেক্ষিতটা বদলে যায়।
এই আন্দোলন নিয়ে নানা রকমের আলোচনা চলছে, বিতর্করও শেষ নেই। অনেক অডিও টেপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডকে মূলধন করে মমতা ব্যানার্জির সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতির রুটি সেঁকবে— এতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটা চিরকাল হয়ে এসেছে। কিন্তু একজন সংবাদিক হিসেবে শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গের একজন বাসিন্দা হিসেবে, একজন বাঙালি হিসেবে আজ এই অস্থির বেদনার সময় বারবার মনে হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী তথা সরকারের সঙ্গে ডাক্তারদের নিঃশর্ত আলোচনা হওয়াটা জরুরি। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের রাস্তা না খুঁজলে পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু আরও বেশি করে নৈরাজ্যের পথে চলে যাবে।
এই ঘটনায় সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো, দুষ্টচক্র, দুর্নীতির নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। সোশ্যাল মিডিয়াল প্রচারিত সব তথ্য সত্য নয়। এর মধ্যে রয়েছে বহু ফেক তথ্য। তবু রাজহংসের মতো জলটুকু বাদ দিয়ে যদি শুধু দুধটুকু গ্রহণ করার মানসিকতা থাকে, তাহলেও কিন্তু মনে হয় যে, এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দুর্বলতা গুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে বেরনোরও একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি সেই দুর্বলতা গুলিকে দূর করতে সচেষ্ট বলেছেন, সর্বসমক্ষে জানিয়েছেন।
কিছুদিন আগেই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তৃতীয়বারের জন্য মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এখনই কোনও ভোট নেই। উদ্দেশ্যটা যদি মমতা ব্যানার্জি সরকারকে দুর্বল করা হয়। তার জন্য প্রচার, প্রেস কনফারেন্স, আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক— সবই ভাল। কিন্তু ভোটের পথে না গিয়ে বাংলাদেশে যেভাবে শেখ হাসিনাকে সরানো হয়েছে, সেইরকম ভাবে একটা গণ আন্দোলনের মডেল তৈরি করা। নানারকম কায়েমি স্বার্থ, নানারকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যেভাবে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়া করেছেন, ঠিক সেইভাবে যদি মমতা ব্যানার্জিকে সরানো সম্ভব হয়— এমনটা হয়তো ছিল বহু বিরোধী শিবিরের অভিলাষ।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মমতাকে ভোট দিয়েছেন। গণতন্ত্রে সবসময়ই রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক মেরুকরণ কিঞ্চিৎ বেশিই বলা যায়। সেখানে প্রতিপক্ষ থাকবে না, তা তো হতে পারে না। কিন্তু প্রতিপক্ষকেও গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে হবে। তা না হলে কিন্তু রাজ্যটা রসাতলে যাবে। দিল্লিতে কর্মসূত্রে এত বছর আছি। এখনও কলকাতা-দিল্লি আসা-যাওয়া করি। এবারো দিল্লি এসে দেখছি, সর্বভারতীয় স্তরে বিভিন্ন মিডিয়া হাউসের প্রচারের ঢক্কা নিনাদে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে আরও নেতিবাচক ছবি তৈরি করা হচ্ছে। সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন না করে কেষ্ট বেটাই চোর— এইরকম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গকে একক ভাবে কালো রাজ্যের তকমা দেওয়া হচ্ছে। সেটাও কিন্তু কাম্য নয়।
পশ্চিমবঙ্গে যখন আমাদের শিল্পায়নের প্রচেষ্টায় গণ আন্দোলনে রাস্তায় নামার কথা ছিল, শিক্ষার দুর্বলাতা কাটিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়ার অদম্য আকাঙ্খা নিয়ে যখন বাঙালির সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল, তখন এই রাজনীতির কৃষ্ণ গহ্বরে একটা নবীন প্রজন্মকে ষড়যন্ত্রের পথে ঠেলে দেওয়াটাও কিন্তু বাংলার জন্য কাম্য নয়। ভুল হয়নি, তা নয়। প্রশাসনেরও অনেক দায়িত্ব আছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অনড় মনোভাব দেখিয়েছেন, সেটাও বলা যায় না। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলন থেকে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ আলোচনার পথে আসুক— এটাই কাম্য।
Advertisement
এই বিভাগের আরও খবর
Advertisement